মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে

আশিমা চিব্বার পরিচালনায় এবং জি স্টুডিওস ও এমমে এন্টারটেইনমেন্ট প্রযোজনায় 'মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে' মুভিটা মাত্র দেখে শেষ করলাম। জানতে পারি, সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র এটি। মূলত গল্পটি সাগরিকা ভট্টাচার্যের সাথে বাস্তব জীবনের ঘটনার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যিনি তার স্বামী অনুপ ভট্টাচার্যের সাথে দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করছিলেন। তারা চাকরির জন্য নরওয়েতে চলে যান। ২০১১ সালে, শিশুদের প্রতি অনুপযুক্ত আচরণের কারণে বার্নেভারনেট (এটি নরওয়েজিয়ান চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিস নামেও পরিচিত) দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তারা সন্তানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। প্রথমে তারা নরওয়ের আদালতে আপিল করলেও ব্যর্থ হয়। পরে তারা বিদেশ মন্ত্রক, ভারত সরকারকে হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানায়। এর আগে সাগরিকা আর তার স্বামীর বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং সন্তানদের হেফাজত তাদের বাবার ভাইকে(কাকা) দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে, তিনি দুই বছরের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ভারত সরকারের হস্তক্ষেপের পর তাকে কলকাতা হাইকোর্ট মধ্যস্ততায় তার সন্তানদের ফিরে পান।
ছবি দেখতে দেখতে অঝোরে কেঁদেছিলেন মুভিটির বাস্তব চরিত্র সাগরিকাও। চোখে জল নিয়েই তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি ভালো মা না খারাপ মা জানি না, তবে আমি একজন মা। মা তার সন্তানদের জন্য সবকিছু করতে পারেন। রানি ম্যাম ধন্যবাদ, উনি আমার মন জয় করে নিয়েছেন। আমি ভীষণ খুশি।
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র, মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রানী মুখার্জী। একই অনুভূতি হয়েছিল তারও।
মুভিটা দেখে অনেকেই বলেছেন, মা হও তো মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জির মতো হও। মুভিটা দেখার পর আমি বলবো, মা হও তো মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জির মতো হও। আর পিতা হও দায়িত্বশীল, অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জির(অনির্বাণ ভট্টাচার্য) মতো পিতা হইও না।
কাহিনীর মূল চরিত্র মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জি পুরো মুভিতে তার পাঁচ মাস বয়েসী ও চার বছরের শিশু সন্তানকে আইনি কাস্টোডি থেকে নিজ দায়িত্বে নিতে লড়েছেন দীর্ঘ ২ বছর। শিশুদের প্রতি অনুপযুক্ত আচরণের কারণে মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জির বিরুদ্ধে চাইল্ড এবিউজ মামলা হয়। ঘর অপরিষ্কার থাকা, দুটো ছোট বাচ্চাকে একসাথে সামলাতে না পারা, কাটা চামচ ছাড়া হাত দিয়ে জোর করে খাওয়ানো, স্কুলে ঠিক মতো শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারা... এগুলোই ছিল নেগ্লিজেন্ট এবিউজ, মামলার অন্তর্ভুক্ত।
আর এই বিষয়গুলো ১০ সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করার পরই মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জিকে সন্তান পালনে যত্নহীন ধরে তার বাচ্চাদের ফস্টারকেয়ারে নেয়া হয়।
এর পিছনে কারণ ও দায়ভার আমি দিতে চাই তার স্বামী অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জিকে। যে পরিবারে একজন স্বামী শুধু চাকরি নিযে ব্যস্ত থাকেন, স্ত্রীর প্রয়োজনীয় ফোন কল রিসিভ করেন না, স্ত্রীকে শাসনে রাখেন, মতের অমিল হলেই মারধর করেন, সংসারের কাজে স্ত্রীকে কোন ধরনের সাহায্য করেন না, বাচ্চাদের পড়াশোনা, যত্নে কোন ভূমিকা রাখেন না, সেই পরিবারে একজন নারী যিনি ভালো ইংলিশ বলতে ও বুঝতে পারেন না, তিনি কি করে কমিউনিকেট করবে বাচ্চাদের শিক্ষক ও চিকিৎসকের সাথে? তিনি একা কি করে ঘর, বাচ্চা, স্কুল, রান্না, স্বামীর যত্ন-সব সামলাবেন? নিজ দেশে হলে বাড়তি সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু বিদেশে? দুইজনকেই একে অন্যের সাহায্যকারী ও সহযোগী হতে হয়, যা এই দম্পত্তির মাঝে ছিল না।
মুভিটার দুঃখজনক এপিসোড ছিল চারটি। এক-মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জিকে তার নিজ স্বামী মানসিকভাবে স্থিতিশীল নন বলে ঘোষণা করেন কোর্টে। দুই-অর্থের লোভে মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জির বাচ্চাদেরকে তারই স্বামীর সহযোগিতায় হস্তান্তর করা হয় দেবরের কাছে। তিন-মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জি যখন বাচ্চাদের হারিয়ে দিশেহারা, এখানে ওখানে দৌঁড়ান সাহায্যের জন্য, তখন তার স্বামী ও স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকে কোন সাহায্য না করে, তার মানসিক অবস্থা বিবেচনা না করে বরং উল্টো তাকে অভিযোগ করা হয়-"সকালে শ্বশুর শাশুড়ির জন্য নাস্তা না বানিয়ে সেজেগুজে সে কোথায় যাচ্ছে।" চার-একজন পিতা হিসাবে বাচ্চাদের সোশ্যাল ওয়ার্কার ও ফস্টারকেয়ার কাস্টোডি থেকে উদ্ধার করতে অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি একজন ব্যক্তিগত ল'য়ার পর্যন্ত ডাকেননি। তিনি টাকার হিসাব করছিলেন। তার কাছে সিটিজেনশিপ ছিল মুখ্য।
মুভিতে প্রধান কালচারাল কনফ্লিক্ট ছিল দুটো। দেশ-বিদেশের শিশু যত্নের পদ্ধতি ও ভিন্নতা, এবং ইমোশোনাল এক্সপ্রেশন। আমরা বাঙালি ইন্ডিয়ানরা হাত দিয়েই বাচ্চাদের খাওয়াই। খেতে না চাইলে জোর করে মুখে তুলে দিই। আমাদের অনেকের ঘর বাড়িতেই তেলাপোকা ইঁদুর থাকে রান্নার তেল চিটচিটে গন্ধ ও মশলার ব্যবহারে। প্রায়শই অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয়। একা একাধিক সন্তানদের যত্ন নিতে গিয়ে অনেক সময় সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয় না। তার উপর স্বামীর সাথে যদি সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকে, সেটাও নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে একজন নারীর উপর। আর ইমোশন, অর্থাৎ আবেগের কথা বলতে গেলে, আমরা বিশ্বের সেরা আবেগী মানুষ। আবেগে আমরা কখনো খিকখিক করে বা লাফাতে লাফাতে হাসি, আবেগে আমরা কান্না করি, চিৎকার করি, যার দুটোই বিদেশীদের কাছে 'পরিবেশ পরিস্থিতি' সাপেক্ষে অস্বাভাবিক আচরণ। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না জানা মানে-তাদের কাছে সেটা মানসিক দুর্বলতার লক্ষণ, যা মূলত মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জির বিপক্ষে অপরপক্ষ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন।
আমরা ছোট ছোট বিষয়ে হতাশ হই, উদ্বেগ বাড়ে। সেক্ষেত্রে মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জির জন্য হতাশায় পড়া, উদ্বেগে জড়ানো খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আইন আদালত কখনোই অপরাধেীর এই বিষয়গুলো অপরাধের কারণ হিসাবে দেখেন না। তবে মিসেস দেবিকা চ্যাটার্টি অবশেষে কলকাতা হাইকোর্ট সেই সাপোর্ট পেয়েছিলেন। তাছাড়া বাবা-মায়ের সাহায্য-সহযোগিতা ছিল তার লড়াইয়ের জন্য প্লাস পয়েন্ট।
সবচেয়ে ভয়ানক যে আইনি সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল মিসসে দেবিকা চ্যাটার্জিকে, সেটা ছিল-ফস্টারকেয়ার থেকে নিজ বাচ্চাদের লুকিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা। একজন মায়ের কাছে তার সন্তান আগে। মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জির আর কোন উপায় ছিল না তার বাচ্চাদের ফিরে পাবার। তাই একজন মায়ের জায়গা থেকে তিনি যা সঠিক মনে করেছেন, তাই করেছেন। এটি যে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, সেটা তার চিন্তায় ছিল না। এই কাজটার পিছনে কেবল একজন মায়ের আবেগ জড়িত নয়, বরং একজন মায়ের শক্তি, সাহস ও ভালোবাসা জড়িত। জড়িত একজন নারীর সন্তানের প্রয়োজনে বিশ্বের যে কোন আইনের বিপক্ষে যাবার উদাহরণ।
একজন পাঠক দর্শক হিসাবে আমি বলব, সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই মুভিটা থেকে আমরা দুটো লেসন পেতে পারি। এক-বাচ্চাদের সুস্থ সুন্দর একটি পরিবার ও পরিবেশ উপহার দিতে, কেবল একজন মায়ের ভূমিকাই যথেষ্ট নয়, বাবাকেও সমান দায়িত্বশীল হতে হবে। দুই-আমরা যারা বাইরের দেশে থাকি, তাদেরকে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে, সন্তানের যত্নে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। কারণ বাইরের দেশগুলোতে শিশুদের ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্কটে পড়তে হয়, যেমন-সন্তানের উন্নতিতে স্কুলে নিয়মিত শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ রাখা, ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে তার কারণ হিসাবে স্কুলে উপযুক্ত একটি নোট পাঠানো, নখ কাটা, পরিষ্কার কাপড় পরানো, ঘরের পরিবেশ সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি। বাইরের
দেশের স্কুলগুলোতে এসব নজরে রাখা হয়। কোনো গড়মিল হলেই সোশ্যাল ওয়ার্কার ইনভল্ভ হয়ে যান। আর তখনই অনেক পেরেন্সদেরকে ভয়ানক সব সঙ্কটে পড়তে হয়। তবে, বাইরের দেশগুলোর নিয়ম, আইন, বিধি-নিষেধে ভিন্ন জাতি, গোত্রের সংস্কৃতি সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা রাখা দরকার। বুঝতে হবে, ডাইভার্সিটি (বৈচিত্র) এবং ইনক্লুশনের (অন্তর্ভুক্তি) তাৎপর্য। ডাইভার্সিটি একটি শব্দ যা একটি দলে প্রতিনিধিত্ব করা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতাকে বোঝায়। ডাইভার্সিটি-লিঙ্গ, আর্থ-সামাজিক পটভূমি, লালন-পালন, ধর্ম, শিক্ষা, যৌন অভিযোজন, লিঙ্গ পরিচয়, জাতিসত্তা, স্নায়ুবৈচিত্র্য এবং জীবনের অভিজ্ঞতা সহ বিস্তৃত অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করে। ইনক্লুশনে প্রত্যেক ব্যক্তির শিক্ষা, সম্পদ, সুযোগ বা অন্য যেকোন গুণাবলির উপর ভিত্তি করে যা তাদের অনন্য করে তোলে, তাতে অ্যাক্সেস করার সমান সুযোগ দেয়।
'মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে'- সন্তানের নিরাপত্তা ও যত্নে একজন নারীর, একজন মায়ের শক্তিকেও উপস্থাপন করে।
বাস্তব ঘটনাটি মর্মান্তিক হলেও, মুভিটি ছিল ভালো লাগার মতো কিছু যেখানে পাঠক দর্শক হিসাবে আমাদের জন্যও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।